বিগত মাসে যৌনকর্ম নিয়ে ঐতিহাসিক রায় দিল সুপ্রিমকোর্ট। এই রায়ে আদালতের তরফে নির্দেশ দেওয়া হল যে, পুলিশ যেন আর যৌনকর্মীদেরকে হেনস্থা না করে। আর পাঁচটা পেশার মতোই পুলিশ যেন প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বেচ্ছায় হওয়া যৌনকর্মীদের প্রাপ্য মর্যাদার সঙ্গে আচরণ করে।

আদালতের বিচারপতি ১৪২ ধারার অধীনে বিশেষ ক্ষমতার প্রয়োগ করে বিচারপতি বলেন, “এটা আমরা অস্বীকার করতে পারিনা যে, পেশা যাই হোক, সংবিধানের ধারা ২১-এর অধীনে সবারই সমান মর্যাদা পাওয়ার ও সসম্মানে জীবন অতিবাহিত করার অধিকার রয়েছে”।

Advertisements
Appy Family Salon AD Banner Use Code to get Discount

যৌনকর্মী কারা?
‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন’ অনুসারে ‘যৌনকর্ম’ কথাটিতেই ‘কর্ম’ শব্দটি লুকিয়ে আছে। এক্ষেত্রে কর্মীরা মূলত টাকার বিনিময়ে নিজের ‘যৌনতা’ বিক্রি করে থাকেন। এই পেশায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো একটা মানুষ দারিদ্রতা ও বেকারত্বের জেরেই এই পেশাকে বাছতে বাধ্য হন। অপরদিকে, ‘বেশ্যাবৃত্তি’ শব্দটি অনেকটাই অপরাধমূলক ও অনৈতিক কাজকর্মের দিকে নির্দেশ করে।

প্রতীকী ছবি

ভারতে যৌনবৃত্তি:
দাসরা ফাউন্ডেশন, দ্য হামিংবার্ড ট্রাস্ট ও কামোনো হাসি প্রজেক্ট অনুসারে ভারতে প্রায় ৩ মিলিয়নের মতো মহিলা বাণিজ্যিকভাবে যৌনবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালে একটি তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। এই তথ্য ছিল ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের সঙ্গে তুলনা করে। সেই তথ্যে যৌনকর্মীদের পরিসংখ্যায় ৫০ শতাংশের বৃদ্ধি দেখা গেছিল।

৩৫ শতাংশেরও বেশি যৌনকর্মী ১৮ বছরে পা দেওয়ার আগেই যৌনবৃত্তিতে প্রবেশ করে। দুর্ভাগ্যবশত, ৬০ শতাংশেরও বেশি কিশোরী (১২-১৬ বছর বয়সী) পাচারের মাধ্যমে যৌনকর্মে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। ভারত বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে যুক্ত যৌনকর্মী ছাড়াও ৫ মিলিয়ন শিশু তথা নাবালিকা যৌন কর্মীদের আঁতুড় ঘর হয়ে পড়েছে। এটা হয়েছে, ১ হাজার ১০০টির মতো চিহ্নিত রেড লাইট এরিয়ার ৩ লক্ষেরও বেশি যৌন আলয়ে নাবালিকা যৌন কর্মীদের উপস্থিতির কারণেই।

প্রতীকী ছবি

বাণিজ্যিকভাবে যুক্ত যৌনকর্মীদের পরিসংখ্যার নিরিখে ৩৫% যৌনকর্মী নিয়ে প্রথম স্থানে রয়েছে মহারাষ্ট্র। এই তালিকতেই ১৩ শতাংশ যৌনকর্মী নিয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। অপরদিকে, রয়টার্সের বিশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৬ মিলিয়নেরও বেশি মহিলা ও নাবালিকা যৌন কর্মের জন্য মানব পাচারের শিকার হন। ‘লিগ্যাল সার্ভিস অফ ইন্ডিয়া’ অনুসারে ভারতে প্রত্যেক ঘন্টায় প্রায় ৪ জন যৌন কর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়। এর মধ্যে ৩ জন নিজের অনিচ্ছায় যৌনকর্মে যুক্ত হতে ‘বাধ্য’ হয়।

ভারতে যৌনকর্মীদের জন্য কি কোনো আইন রয়েছে?
আপাতত এখনও পর্যন্ত যৌনকর্মীদের জন্য সংসদের তরফে কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। ব্যাপক অর্থে বিশ্লেষণ করতে গেলে আসলে যৌনকর্ম আইপিসি (ইন্ডিয়ান পেনাল কোড) অনুযায়ী বেআইনি নয়। কিন্তু, এই আইনের অধীনে কিছু কার্যকলাপ নিশ্চিতরূপে বেআইনি। যে সমস্ত কার্যকলাপগুলি বেআইনি, সেগুলো হল যথাক্রমে- (১) জনসাধারণের মাঝে প্রকাশ্যে যৌনকর্মের অনুরোধ, (২) হোটেলে যৌন কার্যকলাপ চালাতে থাকা, (৩) যৌন কার্যকলাপ চালিয়ে চাওয়ার জন্য যৌনকর্মী ও ‘খদ্দের’-এর আয়োজন করার কাজে নিযুক্ত থাকা।

প্রতীকী ছবি

দ্য ইমমোরাল ট্রাফিক (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট, ১৯৮৬’ অনুযায়ী, যৌনকর্মীদের গ্রেফতার করা যেতে পারে, যদি দেখা যায় যে, তাঁরা যৌনকর্মের জন্য অনুরোধ করছে বা অন্য কাউকে যৌনকর্ম জড়িত হওয়ার প্ররোচনা দিচ্ছে। ‘কল গার্ল’দের তরফে নিজের ফোন নং প্রকাশ্যে আনা বেআইনি। এক্ষেত্রে, তাঁরা যদি আইন ভঙ্গ করে, তাহলে তাঁদেরকে জরিমানা সহ ৬ মাসের জন্য জেলে যেতে হতে পারে। এই প্রসঙ্গে বলতে গেলে, সংবিধানের ধারা ২৩-এর সংশোধনের কথা চলেই আসে। এই ধারা সংশোধন করার মাধ্যেম মানব পাচার ও বলপূর্বক কাজ করানো বেআইনি করা হয়েছে।

‘যৌনকর্ম’ ও ‘যৌনকর্মী’ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কী রায় দিয়েছে?
বিচারপতি এল. নাগেশ্বরের নেতৃত্বাধীনে থাকা তিন বিচারপতি বেঞ্চের তরফে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়, “আইনের চোখে যৌনকর্মীরা সমান সুরক্ষার অধিকারী। একইসঙ্গে সমস্ত মামলায় ‘বয়স’ ও ‘সম্মতির’ ওপর নির্ভর করে শাস্তি বিচার তথা প্রদান করা উচিত। কর্মরত যৌনকর্মী প্রাপ্তবয়স্ক ও সসম্মিতে যৌনকর্মের কাজে নেমেছে, এটা নিশ্চিত হয়ে গেলে, পুলিশকে সেই কাজে হস্তক্ষেপ করা বা অপরাধমূলক শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে”।

আরও বলা হয় যে, “যৌনকর্মীদের প্রতি পুলিশের আচরণ প্রায়শই পাশবিক ও হিংসাত্মক থাকতে দেখা গেছে। যৌনকর্মীরা যেন এমন শ্রেণী হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাঁদের অধিকারই এখনও অজ্ঞাত”। এছাড়াও আদালতের তরফে যৌনপল্লীতে ‘রেড’ করার ব্যাপারেও পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আদালতের তরফে বলা হয়, “যদি এমনও হয় যে, কোনো যৌন আলয়ে পুলিশের তরফে ‘রেড’ করা হয়েছে, তখনও যৌনকর্মীদের গ্রেফতার করা, দণ্ডিত করা, নির্যাতন করা উচিত নয়। কারণ, স্বেচ্ছায় যৌনকর্ম বেআইনি নয়, কিন্তু যৌন আলয় চালানো বটে”।

যৌনকর্মী ও তাঁদের সন্তানদের ব্যাপারে কী বলল আদালত?
যৌনকর্মীরা নিজেদের সন্তানকে নিজেদের কাছে রাখতে পারবেন কিনা, সেই নিয়েই মন্তব্য করল আদালত। আদালতের তরফে বলা হয় যে, যৌনকর্মী ও তাঁদের সন্তান আর পাঁচটা মানুষের মতো সামাজিক সৌজন্য ও সামাজিক মর্যাদার মতো মৌলিক সুরক্ষা পাবে। একইসঙ্গে এও বলা হয় যে, কোনো মহিলা যৌনকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকলেও, এর ভিত্তিতে কোনো সন্তানকেই তাঁদের মায়ের থেকে আলাদা করা যাবে না।

সুপ্রিম কোর্টের তরফে বলা হয়, “যদি কোনো মামলায় কোনো যৌনকর্মী দাবি করেন যে, সেই ছেলে/মেয়ে তাঁর সন্তান, তখন পরীক্ষার আয়োজন করা হবে। এটা যাচাই করার জন্য যে, সেই ছেলে/মেয়ে উক্ত যৌনকর্মীর সন্তান কিনা। এক্ষেত্রে যৌনকর্মীর দাবি যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে সেই সন্তানকে তাঁর মায়ের কাছ থেকে বলপূর্বক আলাদা করা যাবে না”।

এই পর্যবেক্ষণে মন্তব্য করা হয়েছে মিডিয়ার ভূমিকা ও এই ব্যাপারে কোনো মানুষের ঈক্ষণকামী আচরণ নিয়েও। বলা হয়েছে, এই ধরণের আচরণ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। বলা হয়েছে, “উদ্ধারকার্য, রেড বা গ্রেফতার চলাকালীন কোনো যৌনকর্মীর পরিচয় প্রকাশ্যে যাতে না আসে, সেই ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে যৌনকর্মী মানব পাচারের শিকার হোক বা অভিযুক্ত হোক, কোনোভাবেও কোনো ফটো প্রকাশ্যে আনা যাবে না তথা পাবলিশ বা টেলিকাস্ট করা যাবে না”।