বাহক নিউজ় ব্যুরো: বালিশে মাথা রাখতেই আপনার ঘুম চলে আসবে, এমন ঘুমের কি আপনি স্বপ্ন দেখেন? কিন্তু, শুনে রাখুন এই ঘুম কিন্তু মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। আবার, বালিশের মাথা রাখার পরে পরবর্তী ১৫ মিনিটের মধ্যে আপনার ঘুম না আসে, তাহলে সেটাও স্বাস্থ্যকর নয়। সে যাই হোক, আপনাকে ধৈর্য ধরে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আপনার ঘুম আসবে। কিন্তু, যতই মনে মনে ভাববেন যে, ঘুম কেন আসছে না, ততই আপনার ঘুম আসবে না।
বালিশে মাথা রাখতেই ঘুমিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ‘স্লিপ মেডিসিন’ (Sleep medicine) বিভাগের ইন্সট্রাক্টর রেবেকা রবিন্স (Rebecca Robbins) জানিয়েছেন, ” সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কোনো ব্যক্তি কখনওই বালিশে মাথা দিতেই ঘুমিয়ে পড়বে না। তিনি আরও বললেন, “সে যাই হোক, ধৈর্য ধরুন, বিশ্বাস রাখুন যে ঠিক ঘুম আসবে এবং আপনি যতই এই নিয়ে ভাববেন ততই আপনার ঘুম না আসার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে”।
বালিশে পড়তেই খুব তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ার সম্ভাব্য অর্থ আপনার ঘুম কম হয়েছে। যেটা কিনা আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ‘স্লিপ ফর সাকসেস’ বইয়ের লেখিকা রবিন্স উপযুক্ত ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে একটি দারুণ উদাহরণ টেনে বলেছেন, “মনে করুন, আপনি অনেক্ষণ ধরে উপোস করেছেন। এবার, এক্ষেত্রে, আপনি যখন খাবার সুযোগ পাবেন আপনি একবারে অনেকটা খাওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু, যে সময় মতো খাওয়া-দাওয়া করছে, সে কিন্তু কখনওই একবারে অনেকটা বেশি খাওয়ার চেষ্টা করবে না”।
ইউএস সেন্টার্স অন ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (US Centers on Disease Control and Prevention) অনুসারে, ছোট ছোট বাচ্চাদের রাতে একটানা ৯-১২ ঘন্টা ঘুমানো উচিত, কিশোর-কিশোরীদের রাতে একটানা ৮-১০ ঘন্টা ঘুমানো উচিত এবং একজন প্রাপ্ত বয়স্ককে এক রাতে কমপক্ষে ৭ ঘন্টা ঘুমানো উচিত।
আবার, ঘুম বিশেষজ্ঞ তথা দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কেক স্কুল অফ মেডিসিন (Keck School of Medicine)-এর ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ রাজ দাশগুপ্ত বলেছেন, “ঘুমের মান তখনই খারাপ হয়, যখন রাতের বেলায় বারংবার কোনও না কোনও কারণে ওই ঘুম ভাঙতে থাকে”।
তিনি আরও বললেন, “মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙতে থাকার কারণে ঘুমের নির্দিষ্ট কয়েকটি ধাপ ভালোভাবে সম্পূর্ণ হতে পারে না”। উল্লেখ্য, মানবদেহে একই প্রকারের ঘুম সারা রাতে হয় না, গভীর ঘুম (স্লো ওয়েভ স্লিপ তথা ডেল্টা স্লিপ) হয়, হালকা ঘুম (রেম অর্থাৎ র্যাপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ) হয়।
হালকা ঘুম অর্থাৎ রেম স্লিপের সময়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে। এই গবেষণা অনুসারে রেম স্লিপ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, রেম স্লিপের পরিমাণ কম হলে তা মৃত্যুর ঝুঁকিও বহন করতে পারে। অপরদিকে, গভীর ঘুম তথা স্লো ওয়েভ বা ডেল্টা স্লিপ সেই ঘুমটাকে বলে, যখন আমাদের মস্তিষ্ক টক্সিন অর্থাৎ বিষাক্ত বস্তু ত্যাগ করে। এটা অনেক ঘর পরিষ্কার করার মতো, যেটা প্রতিনিয়ত করতে হয়, অর্থাৎ যা সমস্ত কিছু সঠিকভাবে সচল রাখার জন্য বাধ্যতামূলক।
আমেরিকান স্লিপ অ্যাসোসিয়েশন (American Sleep Association) অনুসারে, “আপনি যদি আপনার ঘুমের পরিমাণ মোটের ওপর ঠিক রাখতে চান, তাহলে একটাই কাজ করতে পারেন, নিজের গভীর ঘুমের পরিমাণ বাড়ান”। কোনো কারণে যদি বারংবার আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে থাকে, তাহলে জানবেন আপনার উপযুক্ত ঘুম মোটেই হচ্ছে না।
নীচে কিছু পদ্ধতি দেওয়া হল, যেগুলো অনুসরণ করলে, দ্রুত আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন। যদিও, ডাঃ দাসগুপ্ত বলেছেন, “এই সমস্ত কিছু করেও যদি আপনার ঘুমের সমস্যা ঠিক না হয়, তাহলে আপনার উচিত কোনো ঘুম বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা করানো”।
কীভাবে দ্রুত ঘুমাবেন?
১. উঠে পড়ুন: বালিশে মাথা রাখার পরে ২০ মিনিট পরেও যদি আপনার ঘুম না আসে, তাহলে আপনার ঘুমানোর অবস্থান বদলে ফেলুন। অর্থাৎ সম্ভব হলে, অন্য ঘুমানোর জায়গায় বা অন্য ঘরে যান। এমন একটা জায়গায় যান, যেখানে ক্ষীণ আলো রয়েছে এবং নিজেকে শান্ত করার জন্য কিছু একটা করুন, যাতে আপনার ঘুম চলে আসে। এই পন্থা তখনও ব্যবহার করতে যখন মাঝ রাতে আপনার ঘুম ভেঙে যায় এবং আপনার ঘুম আসে না”।
২. ঘুমানোর ঘরকে তথা বিছানাকে সম্মান দিন: ঘুমানোর ঘর তথা বিছানা থেকে যতটা পারবেন অন্যান্য জিনিসপত্র সরিয়ে রাখুন। যাতে আপনি আপনার মস্তিষ্ককে ঘুমের উপযুক্ত পরিবেশের জন্য একধরণের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন। যে প্রসঙ্গে ডাঃ দাশগুপ্ত জানিয়েছেন, “আপনার মস্তিষ্ক যখন জানতে পেরে যায় যে, কোন পরিবেশে কী করতে হবে, তখন উপযুক্ত কাজ করতে আর অসুবিধা হয় না। অর্থাৎ, আপনি যদি একটি নির্দিষ্ট ঘুমের পরিবেশ বানিয়ে রাখেন, তাহলেও সেই স্থানে প্রবেশ করতেই খুব সহজেই আপনার শরীর ঘুমকে আপন করে নিতে পারবে”। অর্থাৎ, ঘুমানোর জন্য বিছানায় যাওয়ার পরে বিছানায় বসে টিভি দেখা, কাজ করা, মোবাইল ঘাঁটা, ফোন কল করা অথবা বারংবার সেল ফোন চেক করা ইত্যাদি কোনওকিছুই করা যাবে না।
৩. ঘুমানোর জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ তৈরি করুন: ঘুমানোর জন্য আপনার মস্তিষ্ককে নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট সময়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করুন। ঘর ঠান্ডা ও অন্ধকার রাখুন। বিজ্ঞান অনুযায়ী, মানুষ শীতল উষ্ণতা সম্পন্ন জায়গায় তথা ৬০-৬৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট (১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) উষ্ণতায় তুলনামূলক ভালোভাবে ঘুমায়।
৪. একটি নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করুন: রাতে দাঁত মাজুন, গরম জলে স্নান করুন, হালকা আলোয় বই পড়ুন বা কোনো মিষ্টি তথা শান্ত গান শুনুন। এর বদলে আপনি যোগাসনও করতে পারেন। কিন্তু, সেইরকম কিছু করবেন না, যেটা আপনাকে আরও সক্রিয় করে তুলবে। আপনাকে সেই সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যেগুলো আপনার মস্তিষ্ককে শান্ত হতে সাহায্য করবে। এই প্রসঙ্গে সিডিসি (Centers of Disease Control and Prevention)-এর বলা হয়েছে, “প্রতিদিন একই সময়ে বিছানায় ঘুমোতে যান এবং সকালে একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করুন। উল্লেখ্য, ছুটির দিনেও এই নিয়ম ভাঙবেন না”। প্রথম প্রথম অসুবিধা হয় ঠিকই, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পরে এটাই অভ্যাস হয়ে যাবে।
৫. অশান্ত মনকে শান্ত করুন: বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই ঘুমানোর পদ্ধতিতে এটাই সবচেয়ে কঠিন ধাপ। বর্তমানের ব্যস্ত জীবন ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তায় ভরা। তাই, যখন আপনি বিশেষ কিছু করছেন না, তখন অতীতে কী করেছেন বা করেননি এবং ভবিষ্যতে কী করা উচিত ও কি নয়, তা একলহমায় মাথা থেকে বের করে দেওয়া খুবই কষ্টকর। এই প্রসঙ্গে রেবেকা রবিন্স জানিয়েছেন যে, ঘুমের মান বাড়ানোর জন্য নিয়মিত ধ্যান করা একটি পরীক্ষিত প্রক্রিয়া। তিনি আরও বলেছেন, “ধ্যানের মাধ্যমে আপনার ভাবনাচিন্তাগুলো বিনা বাধায় আপনার সচেতন মনকে প্রভাবিত না করেই চলে যাবে। প্রতিনিয়ত করতে করতে যখন এটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, যখন ধ্যান করার মানসিকতা আয়ত্ত করে নি, তখন আপনাআপনি আমাদের ঘুমের মান বৃদ্ধি পায়।
৬. চিন্তার বিষয়গুলি একপাশে রাখুন: আপনার মনকে শান্ত করার অন্য আরেকটি উপায় হল- ঘুমানোর আগে সমস্ত দুশ্চিন্তা একটি কাগজে (বেশি বড়ো নয় বা কোনো খাতা নয়) লিখে পাশে রেখে দেওয়া। এটাকে আপনি পরে সংগ্রহ করেও রাখতে পারেন। এই প্রসঙ্গে রবিন্স জানিয়েছেন, “ঘুমানোর আগে সমস্তকিছু লিখে ফেলুন। সেটা যতই চাপযুক্ত বা ছোট বা বড়ো হোক না কেন, লিখে রাখুন এবং নিজেকে বলুন যে ওই সমস্ত ঘটনাকেগুলোকে নিয়ে আপনি রাতের বেলায় কিছুই করতে পারবেন না, ‘যা হবে সকালে দেখা যাবে’ এমন একটা হাবভাব আনুন নিজের মধ্যে।
৭. লম্বা করে শ্বাস (প্রশ্বাস) নিন: ঘুমানোর আগে ‘যা হচ্ছে হোক’ এমন একটা মনোভাব আনুন এবং লম্বা করে শ্বাস নিন, এই পন্থা আপনাকে ঘুমোতে সাহায্য করবে। এই প্রসঙ্গে কন্টেন্টমেন্ট ম্যাগাজিনের অন্যতম সম্পাদক তথা ক্লান্তি বিশেষজ্ঞ ডাঃ সিন্থিয়া আক্রিল জানিয়েছেন, “লম্বা করে শ্বাস নেওয়ার অনেক প্রক্রিয়া রয়েছে, তবে সব থেকে যেটা কার্যকরী সেটা হল ‘৬ প্রশ্বাস, ৬ নিঃশ্বাস’ প্রক্রিয়া। এটার জন্য আপনাকে যেটা করতে হবে সেটা হল, মনে মনে ধীরে ধীরে ৬ গুনতে গুনতে প্রশ্বাস নিতে হবে এবং একই পদ্ধতি নিঃশ্বাসের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে হবে। আমি যখন প্রশ্বাস ধরে রাখছেন, তখন আপনি আপনার পেটে হাত দিয়ে নিশ্চিত করুন যে, আপনার পেট যেন হাওয়ায় ভরে ফোলা থাকে। ডাঃ আক্রিল এও বলেন, “এইটা ততক্ষণ করতে থাকুন, যতক্ষণ না আপনার নিজের শরীর ও মন শিথিল বলে মনে হবে”।
এই পন্থাগুলো অবলম্বন করুন এবং আপনি নিয়মিত করতে থাকুন। দেখবেন, একটা সময় এটাই আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে এবং বালিশের অপর নাম ঘুম মনে হবে। একদিন, ‘তাড়াতাড়ি ঘুমানোর স্বপ্ন’ একদিন সত্যি হয়ে যাবে।