বাহক নিউজ় ব্যুরো : আজ বিশ্ব হার্ট দিবস

এমন একটি ধারণা প্রায় মিথ হিসেবেই প্রচলিত রয়েছে যে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (সিভিডি) বা হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের শিকার সাধারণত বয়স্কজন এবং মূলত পুরুষরা। এটি যে সত্য নয় তা বলাই বাহুল্য। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শিশু এবং নারীরাও হৃদরোগের ঝুঁকির ভেতরে অবস্থান করছে। আর সে কারণেই এবারের বিশ্ব হার্ট দিবসে শিশু ও নারীর ওপর বিশেষ দৃষ্টিদানের কথা বলা হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, চলতি বছর শিশু এবং নারীর হার্ট সুস্থ রাখার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আমরা কথায় কথায় বলে থাকি শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ সচল রাখার জন্য শিশুর সুস্থ হার্টের দিকে আমাদের বিশেষ দৃষ্টিদানের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তাই হার্ট সুরক্ষার আন্দোলন ও তৎপরতার বাইরে নারীকে রাখা হলে সেটা হবে আত্মঘাতী। সুতরাং এ বছরের বিশ্ব হার্ট দিবসের মূল ফোকাস অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিগত মে মাসের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে অসংক্রামক রোগসমূহের ভেতর হৃদরোগকে অন্যতম ভয়াবহ রোগ হিসেবে শনাক্ত করে ২০২৫ সালের ভেতর এবং রোগে মৃত্যুর হার পঁচিশ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্র্ধারণ করে ১৯৪টি দেশে কর্মসূচি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। বিশ্বের ১০০টি দেশের সঙ্গে ভারতের সর্বত্র পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। আমরা মনে করি, হার্ট দিবস পালন তখনই সার্থক হবে যখন দেশের অপেক্ষাকৃত কম বিত্তবান মানুষ হৃদরোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের আওতায় আসতে পারবে। এজন্য হৃদরোগের বিকল্প চিকিৎসার কথাটিও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।
সারা বিশ্বেই হৃদরোগ একটি ভয়াবহ আকার নিয়েছে। প্রতি বছর বিশ্বে মোট রোগী মৃত্যুর মধ্যে ২৯ ভাগ মানুষ মারা যান হৃদরোগের কারণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনে দিনে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে। এ অকাল মৃত্যুর শতকরা ৮০ ভাগ কমানো যায় যদি তামাক সেবন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করা ও কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে। গত বছর বিশ্বহার্ট দিবসের লক্ষ্য ছিল বিশ্বের প্রতিটি পরিবারের মধ্যে এ রোগবিষয়ক গণসচেতনতা তৈরি করা। আর স্নোগান ছিল ‘এক বিশ্ব, এক ঘর, এক হৃদয়’ (ওয়ান ওয়ার্ল্ড, ওয়ান হোম, ওয়ান হার্ট)।’ এটিও আমাদের এবারের হার্ট দিবসেও মনে রাখা জরুরি।
অসংক্রামক রোগ আজ মারাত্মক সব জনস্বাস্থ্য সমস্যা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। অসংক্রামক রোগের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী সংকোচনজনিত রোগ।

Advertisements
Appy Family Salon AD Banner Use Code to get Discount

অধিকতর কারিগরি নির্ভরশীলতায় আমাদের কম কায়িক পরিশ্রম এবং অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবারের দিকে ধাবিত করছে। যার প্রেক্ষিতে বর্তমানে দেশের শতকরা ৬১ ভাগ রোগই হচ্ছে অসংক্রামক রোগ।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জেনেভায় প্রকাশিত ‘২০১২ সালে বিশ্বে স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান রিপোর্টে’ বলা হয়েছে, হৃদরোগ ও রক্তনালির রোগ এবং ক্যান্সারের ধরনের অসংক্রামক রোগ মানবজাতির স্বাস্থ্যহানির জন্য প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তা আরো তীব্রতর হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কেবল ২০০৮ সালে বিশ্বে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ অসংক্রামক রোগের কারণে মারা গেছে। এ সংখ্যা একই বছরে বিশ্বে মৃত্যুর মোট সংখ্যার প্রায় ৬৩ শতাংশ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে, মানুষের গড়পড়তা আয়ু একটানা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বয়োজ্যেষ্ঠ জনসংখ্যা স্থায়ীভাবে বাড়ছে। ভবিষ্যতে অসংক্রামক রোগের কারণেও মৃত্যুবরণকারী লোকসংখ্যা আরো বাড়বে। অনুমান অনুযায়ী, ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণকারী লোকসংখ্যা ৫ কোটি ৫০ লাখ হবে।
মানসিক উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, আবেগের আগ্রাসন, কাজের বাড়তি চাপ, জীবনযাপনের চাপ প্রভৃতি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ক্রমাগত মানবজীবনে আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যাওয়া, কাজকর্মে তাড়াহুড়ো, আধুনিক জীবনযাত্রায় নিত্যদিনের দুর্ভাবনা সরাসরি মানবদেহের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়া ঘটায় বা প্রভাব ফেলে। জীবনের দৌড়ে যদি গতি বাড়ানো কাজ করে মন, তবে স্বাভাবিকভাবেই চাপ বাড়ে মনে। আজকের মানুষ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে। স্বাভাবিকভাবেই এর জন্য তাকে চড়া দামও গুনতে হচ্ছে। ফলস্বরূপ অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন অসংক্রামক রোগে।
করোনারি আর্টারি বস্নকেজের চিকিৎসা পদ্ধতি এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি কিন্তু বাইপাস সার্জারি অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। কাঁটাছেঁড়া ছাড়া হৃদরোগের বিকল্প চিকিৎসা ঝুঁকিহীন এবং তাতে সাফল্যের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। কোনো তথ্যই গোপন রাখা সম্ভব নয়। রোগীরা সব তথ্য যাচাই বাছাই করে তার বিবেচনামতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। এটাই স্বাভাবিক।

হৃদরোগ প্রতিরোগ ও নিরাময়ে মেডিটেশন এবং লাইফ স্টাইলভিত্তিক বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। আমেরিকার ডা. ডিন অরনিশেনের চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, ব্যায়াম ও মেডিটেশনের মাধ্যমে হাজার হাজার হৃদরোগী অপারেশন ও এনজিওপ্লাস্টি ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
বিশ্ব হার্ট দিবসে আমরা অবশ্যই হৃদয়ের কথা শুনব। ফিরে তাকাব আমাদের হার্টের সুস্থতার দিকে। হার্ট সুস্থ রাখার জন্য যা যা করা দরকার তা করতেই সচেষ্ট হবো। কিন্তু ইতোমধ্যেই যারা হৃদরোগের শিকার হয়েছেন তাদের সামনে প্রচলিত চিকিৎসার পাশাপাশি বিকল্প চিকিৎসার দিকটিও আমাদের তুলে ধরতে হবে। বিকল্প চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে ‘লাইফ স্টাইলের পরিবর্তন, খাদ্যাভাসের পরিবর্তন, যোগব্যায়াম, প্রাণায়াম, মেডিটেশন, নিউরোবিক জিম, চিলেশন থেরাপি ও ইসিপি।’ তথ্যপ্রযুক্তির যুগের তথ্যভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দিতে হবে মানুষের সামনে। হৃদরোগ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সচেতনভাবেই চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। মধ্যবিত্ত, অসচ্ছল এবং দরিদ্র হৃদরোগীরা যাতে যথার্থ চিকিৎসার বাইরে না থেকে যায় সেটাই আজকের প্রধান বিবেচ্য।