Bahok News Bureau: আজ হাওড়া ব্রিজের জন্মদিন (Birthday Of Howrah Bridge)। পরাধীন ভারতে দুই যমজ শহরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিল এই ব্রিজ। ঝুলন্ত ব্রিজটি তৈরি হয়েছিল নাটবোল্ট ছাড়াই। কলকাতার গর্ব হাওড়া ব্রিজের ইতিহাস অনেকেরই অজানা। চলুন এই সূত্রেই অতীতের পাতায় একটু উঁকি মেরে নেওয়া যাক।
হাওড়া ব্রিজের ইতিহাস (History of Howrah Bridge):
হাওড়া ব্রিজের প্রথম প্রস্তাব:
হাওড়া ব্রিজ তৈরি হয়েছিল ১৮৭৪ সালে। তবে, এই ব্রিজ তৈরির তোড়জোড় কিন্তু অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। হুগলী নদীর দুইদিকে ব্রিটিশদের ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ জমে উঠেছিল। এই অবস্থায় সেতুর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার পরে ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৫ সালে সেতু তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠিত হলেও ১৮৫৯-৬০ সালে তা চাপা পড়ে যায়।
এরপরে আবার ১৯৬২ সালে প্রস্তাবটি মাথাচাড়া দেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির চীফ ইঞ্জিনিয়ার জর্জ টার্নবুলকে ব্রিজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করার কাজে নিযুক্ত করা হয়। ওই বছরেই তিনি বানিয়ে ফেলেন ব্রিজের নকশা এবং সেটি পেশ করেন ২৯শে মার্চ তারিখে।
ভাসমান সেতু ‘আদি হাওড়া ব্রিজ’/ পন্টুন ব্রিজ:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সহজ পাঠ’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে ‘হাওড়া ব্রিজ’-এর নিয়ে ছড়া কেটেছিলেন। তবে, সেই ছড়ায় আজকের ‘হাওড়া ব্রিজ’-এর উল্লেখ ছিল না। ছিল ‘আদি হাওড়া ব্রিজ’ তথা ‘পন্টুন ব্রিজ’-কে নিয়ে। এই ব্রিজের নকশা বানিয়েছিলেন ব্রিটিশ জমানার রেল কোম্পানির খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ার স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলি (নৈহাটির জুবিলি ব্রিজের নকশা তিনিই তৈরি করেছিলেন)। ব্রিজটি ছিল ১৫২৮ ফুট দীর্ঘ এবং ৪৮ ফুট প্রশস্ত।
নিচে ‘ভাসমান সমতল নৌকা’ ও উপরে পর পর সাজানো পাটাতন, এমনটাই ছিল ‘আদি হাওড়া ব্রিজ’। কোনো জাহাজ বা স্টিমার এলে ব্রিজটির মাঝবরাবর ২০০ কিমি এলাকা খুলে দেওয়া হত, যাতে জাহাজ বা স্টিমারগুলো যাতায়াত করতে পারে। এই ব্রিজ ১৮৭৪ সালে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, ১৮৫৫ সালের ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন প্রায় ১৯ বছর পরে হল।
স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলি ও তাঁর সংস্থা ব্রিজটি নির্মাণের জন্য ২২ লক্ষ টাকা নিয়েছিল। বার্ষিক প্রায় ১.৫ লক্ষ টাকা টোল আদায়ের মাধ্যমে মোট ৩৪ লক্ষ ১১ হাজার টাকার টোল আদায় করা সম্ভব হয়েছিল। ব্রিজের দৌলতে যান চলাচল ভালোভাবে হতে থাকলেও একটা সময় জাহাজ ও স্টিমারের কারণে সমস্যা দেখা দেয়। বন্দরের নথি অনুযায়ী, ১৯০৭-০৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ৩০২০টি জাহাজ-স্টিমার-লঞ্চ হাওড়া ব্রিজ চিরে পারাপার হয়েছিল। আর ঠিক এই কারণেই বারংবার যানবাহনের চলাচলের ব্রিজ বন্ধ করে দেওয়া হতো। ফলত, যানজট বাড়তে শুরু করেছিল। এই অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার নতুন ব্রিজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
ঝুলন্ত সেতু ‘নিউ হাওড়া ব্রিজ’:
১৯০৬ সালে একটি বিশেষ কমিটি তৈরি করা হয়। এই কমিটির অংশ ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার আর এস হায়েট, বন্দরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার জন স্কট ও কলকাতা কর্পোরেশন এর চীফ ইঞ্জিনিয়ার ডাব্লিউ বি ম্যাকাবে প্রমুখগণ। কমিটি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তথ্য পেশ করে বহির্বাহু সেতু তৈরির প্রস্তাব দেয়।
কিন্তু, স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলি এই প্রস্তাবে অমত প্রদর্শন করেন। তখনও পর্যন্ত পুরো পৃথিবীতে মাত্র ৩টি বহির্বাহু সেতুর অস্তিত্ব ছিল। ১৯১৭ সালে কানাডার বহির্বাহু সেতু ‘পোঁ দ্য কেবেক সেতু’ (Pont de Quebec) ভেঙে পড়ার খবর তাঁর মতামতকে আরও সমর্থন পাইয়ে দেয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁর সঙ্গে সহমত হয় এবং নতুন একটি ভাসমান সেতু তৈরির উপরেই মোহর লাগিয়ে দেয়।
১৯১১ সালে কমিটির কাছে নিউ হাওড়া ব্রিজের নকশা চাওয়া হলে বছর গড়াতেই পুরো দুনিয়া জুড়ে থাকা ৯টি সংস্থার কাছ থেকে ১৮টি নকশা এসে হাজির হয়ে যায়। কিন্তু, কোনো সংস্থার নকশাতেই নতুনত্ব ছিল না। সমস্ত নকশাতেই ব্রিজের মধ্যবর্তী এলাকা খোলা রাখার ব্যবস্থা করা ছিল। এই নকশা মূলত বাসকুল মডেল নামে পরিচিত। ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশরা। এই সময়ে অর্থনীতিও বেশ ভালো রকমের ধাক্কা খায়। এই অবস্থায় নতুন কোনো ব্রিজকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার।
১৯২১ সালে পুনরায় ব্রিজের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। তবে, এইবারে ব্রিটিশ সরকার নতুন পন্থা অবলম্বন করে। এই পন্থা অবলম্বন করার মূলে ছিল ব্রিজের নকশার সমর্থনে মতামতের অমিল। কেউ পন্টুন ব্রিজের দাবি করেন, তো কেউ বহির্বাহু সেতুকে সমর্থন জানান। এই অবস্থায়, ব্রিটিশ সরকার মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানির অন্যতম মালিক স্যার আর এন মুখার্জির (রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়) নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি করে। এই কমিটির সদস্য ছিলেন তৎকালীন কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান ক্লিমেন্ট হিন্ডলে ও চিফ ইঞ্জিনিয়ার জে ম্যাগ্লাসান। এই কমিটি পরামর্শ নেন তৎকালীন বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার বেসিল মট-এর কাছে। এই ইঞ্জিনিয়ারই সর্প্রবথম ‘সিঙ্গল স্প্যান আর্চড ব্রিজ’-এর প্রস্তাব পেশ করেন। এরপরে, আর এন মুখার্জি কমিটি ১৯২২ সালে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করলে তা গৃহীত হয় এবং পন্টুন ব্রিজের বদলে বহির্বাহু ব্রিজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৯২৬ সালে ‘দ্য নিউ হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট’ পাশ হওয়ায় এই ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণ, নির্মাণ প্রভৃতি আইনসিদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৩৫ সালে এই আইন সংশোধন করার পরে ১৯৩৭ সালে ব্রিজটির নির্মাণকার্য শুরু হয়ে যায়। এতে কাঁচামাল হিসাবে ২৬ হাজার ৫০০ টন ইস্পাতের প্রয়োজন পড়েছিল। এরমধ্যে টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানিই সাড়ে ২৩ হাজার টন ইস্পাত দিয়ে দেয় ব্রিজ নির্মাণের জন্য। এই কাজ শেষ হয় ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে। অবশেসে, ১৯৪৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি তারিখে ব্রিজটি জনসাধারণের জন্য অনুমোদিত হয় এবং ১৯৪৫ সালে সেতুটির উদ্বোধন করা হয়।
আরও পড়ুন: দ্রৌপদী মুর্মু: সাধারণ দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এক নারীর যুদ্ধকথা
একনজরে ‘হাওড়া ব্রিজ’:
- প্রথম হাওড়া ব্রিজ তৈরি হয় ১৯৭৪ সালে।
- প্রথম হাওড়া ব্রিজ ছিল ভাসমান সেতু তথা পেন্টুন ব্রিজ।
- নিউ হাওড়া ব্রিজ অনুমোদিত হয় ১৯৪৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি তারিখে।
- নিউ হাওড়া ব্রিজের উদ্বোধন ঘটে ১৯৪৫ সালে।
- এই ব্রিজ হুগলী নদীর উপরে অবস্থিত।
- নিউ হাওড়া ব্রিজ মূলত বড়ো খিলানযুক্ত ঝুলন্ত সেতু।
- ব্রিজটিতে কোনো নাটবোল্ট ব্যবহার করা হয়নি।
- ১৯৬৫ সালের ১৪ই জুন তারিখে নিউ হাওড়া ব্রিজের নামকরণ করা হয়। রবীন্দ্রনাথের নামানুসারে ব্রিজটির নাম রাখা হয় ‘রবীন্দ্র সেতু’।
- বর্তমানে এই সেতুটিকে মোটামুটি ১ লক্ষ পথচারী ও অগণিত যানবাহন যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করে।
- এটি বিশ্বের দীর্ঘতম ক্যান্টিলিভার সেতু হিসাবে পরিচিত।