রমেন দাস: আভাস মিলছিল বুধবার রাত থেকেই। সুর বদল করছিলেন তৃণমূলের একাংশের নেতারা। সুর চড়াচ্ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কুণাল ঘোষ। বৃহস্পতিবার সকাল হতেই বাড়ল জল্পনা। তাহলে কি অভিষেকের হস্তক্ষেপেই শেষ হবে, গুরুতর দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা, দাপুটে মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জমানা! বেলা বাড়তেই অভিষেকের দলীয় বৈঠক ডাকা এবং এসএসসি আন্দোলনরতদের সঙ্গে যোগাযোগের খবরে এই জল্পনা আরও গভীর হয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে পার্থ-প্রসঙ্গ না ওঠায় আরও গভীর হয় সন্দেহ। তাহলে কী! ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্ত। নিমেষেই তিন গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে।

এই নিয়ে শোরগোলের মধ্যেই এদিনই দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল পার্থকে ছেঁটে ফেলার! তৃণমূলের সমস্ত পদ থেকে পার্থকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তার পাশাপাশি পার্থকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাসপেন্ড করল তৃণমূল। অবশেষে দল পুরোপুরি ছেঁটে ফেলল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পার্থ’দা, পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। যা মদন মিত্র বা অন্যান্য তৃণমূল নেতার ক্ষেত্রে হয়নি, এমনকি পুলিশ আধিকারিক রাজীব কুমারকে নিয়েও যার উল্টো পথ ধরেছিল তৃণমূল, ঠিক তার বিপরীত পথে হেঁটে, দলের জন্মলগ্ন থেকে থাকা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। কেউ কেউ এর পিছনে অভিষেকের হাত দেখছেন। বরাবরই অভিষেকের পার্থ-প্রীতি কম থাকায় বিতর্ক কম হয়নি। বিরোধ গড়িয়েছে অনেক দূর।

Advertisements
Appy Family Salon AD Banner Use Code to get Discount

আরও পড়ুন: ‘স্মৃতি ইরানিও রাষ্ট্রপতির অবমাননা করেছেন’, স্পিকারের কাছে পাল্টা দাবি অধীরের

সম্প্রতি, নিজের পদ থেকে অব্যাহতি চান অভিষেক নিজেই। বিতর্কে জল ঢালেন মমতা। শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। আবার তৈরি হয় পুরোটা। দুর্নীতি, এসএসসি নিয়োগ, টাকা উদ্ধার, পার্থ চট্টোপাধ্যায় এঁর বান্ধবী-কাণ্ডের পরে পার্থকে ‘মুকুটহীন’ করতে অভিষেকের ভূমিকা রয়েছে বলে অনেকে দাবি করলেও রাজনৈতিক মহলের একাংশের মত, গত ৭দিনে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রকাশ্য দুর্নীতির পর্দা ফাঁসে তীব্র অস্বস্তিতে তৃণমূল। বিরোধীদের সাঁড়াশি আক্রমণ, সংবাদমাধ্যমের প্রচারে কী ভাবে বিষয়টি চাপা যায়, দলের ভাবমূর্তি রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে চিন্তিত ছিল তৃণমূল নেতৃত্ব। একের পর এক বয়ান বদল তার প্রমাণ।

এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অর্পিতার বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাটে ফের টাকা, সোনা উদ্ধার, আরও অস্বস্তিতে ফেলে রাজ্যের শাসকদলকে। ঠিক এই সময়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে কড়া মনোভাব ব্যক্ত না করলে জনমানসে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই তৃণমূলের এই পদক্ষেপ। এদিকে বিরোধীরা সরব হয়েছেন ফের। তাঁদের দাবি, এতদিন কোথায় ছিলেন? সারদা, নারদার পরেও কেন দুর্নীতিবাজদের সমর্থন করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও এই সিদ্ধান্তের পিছনে মমতার রাজনৈতিক অভিসন্ধি, পিসি-ভাইপোর কৌশল থাকতে পারে বলে অভিযোগ তাঁদের। যদিও, রাজনৈতিক কৌশল, মমতা-অভিষেক গোষ্ঠীর টানাপড়েন থাকলেও এই সিদ্ধান্ত যে এই মুহূর্তে কালিমামোচনে তৃণমূলকে খানিকটা সাহায্য করবে, এমনকি ভাবমূর্তি রক্ষায় সহায়ক হবে, নিচুস্তরের কর্মীদের কাছে বার্তা দেওয়া হবে, যে তৃণমূল এত বড় নেতাকেও ছাড়েনি, সেটাও ভোটের জন্য খানিকটা স্বস্তির, মত রাজনৈতিক মহলের একাংশের।

আরও পড়ুন: মন্ত্রিত্ব বিদায়! অবশেষে মুকুটহীন পার্থ, খোয়ালেন সব দফতর

প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার রাতেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাকতলার বাড়িতে হানা দেয় ইডি। দফায় দফায় চলতে থাকে জেরা। চূড়ান্ত নাটকীয় পরিস্থিতির মধ্যেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের নাম সামনে আসে। অর্পিতার টালিগঞ্জের ডায়মন্ড প্লাজার ফ্ল্যাটে তল্লাশি শুরু করতেই কেঁচো খুঁড়তে কেউটে প্রকাশ্যে আসে। উদ্ধার হয় ২১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। পাহাড় প্রমাণ টাকার সঙ্গেই সোনা, ডলার, কোটি কোটি মূল্যের সম্পত্তির হদিশ পায় ইডি। গ্রেফতার করা হয় পার্থ, অর্পিতাকে। বিতর্কের মধ্যেই চলে পার্থকে নিয়ে চিকিৎসার টানাপড়েন। এসএসকেএম না ভুবনেশ্বর এইমস, কোথায় চিকিৎসা!

এই প্রশ্নের মধ্যেই কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে পার্থকে ভুবনেশ্বরের এইমসে নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষার পরে, ফের ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায়। একাধিক জেলায়, বোলপুরে বহু বাড়ি, ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়ার পরে, বুধবার বিকেলে বেলঘরিয়ায় পার্থর বান্ধবীর ফ্ল্যাটে তল্লাশি শুরু করে ইডি। ফের শুরু হয় নাটকীয় পরিস্থিতি। দফায় দফায় উদ্ধার হয় ৩ কেজির বেশি সোনা। ২৭ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা নগদ। রুপোর কয়েন সহ বিপুল সম্পত্তি। এরপরেই একে একে উঠে আসে বিভিন্ন নাম। অধ্যাপক মোনালিসা দাস-সহ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একাধিক বান্ধবীর খোঁজ শুরু করেছেন ইডি গোয়েন্দারা। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার অভিযুক্ত অর্পিতা দাবি করেন, নিজের নামের ফ্ল্যাটে টাকা রাখতেন পার্থ। মন্ত্রীর কর্মীরা অর্পিতার ফ্ল্যাটে টাকা রেখে যেত বলে দাবি করেন তিনি।