রমেন দাস : দেশের শীর্ষ আদালতে ৯ বছরের লড়াই। অবশেষে বেআইনি, দুর্নীতির নির্লজ্জ নিদর্শনের ধ্বংস হবে। উত্তেজনা চরমে তুলে ভারত-পাক ক্রিকেট যুদ্ধের থেকেও গুরুত্ব দিয়ে লাইভ টেলিকাস্ট হবে সেই ধ্বংসের ছবি। নিমেষেই গুঁড়িয়ে যাবে অহংকারের ইমারত। মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হবে প্রভাবশালীর ক্ষমতা। ধুলোর মতো উড়ে যাবে কোটি কোটি টাকা। আর অহমিকা পতনে খরচ হবে দ্বেষহীন, দেশভক্ত জনতার ২০ কোটি টাকা! বিলাসবহুল টুইন টাওয়ার। অ্যাপেক্স আর সিয়ানে; অতীত হবে আজ দুপুরের পর থেকে। দিল্লির উপকন্ঠে নয়ডার অলিন্দে আজ সাজো সাজো রব।
দূষণ বাড়বে, ধুলো উড়বে। পাশের এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। সম্পত্তি নষ্ট হতে পারে একাধিক। শারীরিক অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে বেআইনি নির্মাণের পাশে থাকা বহু মানুষের। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার এলাকা ঢাকবে ধুলোয়। বাড়বে বায়ুদূষণ। কিন্তু এত ক্ষতির মধ্যেও দেশে দুর্নীতির অন্যতম নিদর্শন ধ্বংস, দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশ পালনই এখানে মুখ্য। আর সেটা নিয়ে আমার বা আপনার কোনও আপত্তি থাকতেই পারে না! থাকছেও না।
আরও পড়ুন: সিনেমা হলে বসে ভারত-পাক ক্রিকেট-যুদ্ধ, বড় পর্দায় খেলা দেখাবেন হল মালিকরা!
তাই বলে কি প্রশ্ন তোলাও অপরাধ? কারণ, বেআইনি নির্মাণ, দুর্নীতির নিদর্শনের ধ্বংসে যে ২০ কোটি জনতার দেওয়া ট্যাক্স খরচ হবে, সেটার দায়?
কেন ৯ বছর ধরে মামলা? একদিনে তো এই অট্টালিকা তৈরি হয়নি। সেখানে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুমতি, অট্টালিকা তৈরি হতে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার, প্রশাসন কী করছিল? আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হল কেন? প্রশাসনিক কর্তাদের অট্টালিকার খরচ কাদের?
যে উৎসাহ নিয়ে এই অট্টালিকা আজ ভাঙা হচ্ছে সেই উৎসাহ কেন এই নির্মাণের সময় ছিল না? এর ধ্বংসে পাশের এলাকার, মানুষের যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তার দায়? কতদিন ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকবে প্রশাসন?
সর্বোপরি, এই প্রলয়কাণ্ডের কি খুব প্রয়োজন ছিল? নাকি সবপক্ষ মিলে আদালতের মাধ্যমে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা যেত সহজেই! কয়েক’শো কোটির নির্মাণ ভেঙে টাকার অপচয়, স্বাস্থ্যের ক্ষতি না করে, এই নির্মাণ তো ভাল কাজে লাগানো যেত!
উত্তরপ্রদেশ সরকার বা কেন্দ্র আদালতে কেন বলতে পারল না একথা। আজ চিকিৎসার জন্য, শিক্ষার জন্য, কর্মসংস্থানের জন্য, মানুষের ভালর জন্য, বিশেষত, বহু ঘরহীন, ছাদহীন দরিদ্রের জন্য একটু ছাদ প্রয়োজন! দেশে কোটির বেশি শিশু, মহিলা আজও গৃহহীন। নিরাপত্তা শিঁকেয় তুলে প্রতিমুহূর্তে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে হয় ওদের। নোংরা, আবর্জনার পাশে আজও ঘর বাঁধে লক্ষ লক্ষ মানুষ। বস্তির ঘিঞ্জি কুঠিরে থেকে অসুস্থ হতে হয় অনেককেই। তাদের জন্য? সর্বোপরি জনহিতে কাজে লাগানো যেত না ওই বেআইনি নির্মাণ।
যা সহজেই সরকার, আদালতের অনুমতিতে আইন মেনেই অধিগ্রহণ করতে পারত। যে অপরাধ করা হয়েছে, তার উপযুক্ত শাস্তি নির্মাণকারী সংস্থাকে দিয়েই ওই নির্মাণকে ভাল কাজে লাগানো যেত না? প্ল্যান, পরিবেশ, নির্মাণের নকশা; যদি সবক্ষেত্রেই ত্রুটি থাকে, সেখানেও বিরাট বিরাট সরকারি দফতর, সরকারি ইঞ্জিনিয়ররা তা ভাল কাজে লাগানোর তাগিদে, আগের ঘুষখাওয়া অবতার ভুলে সংশোধন করতে পারতেন না? অন্তত পুরো অট্টালিকা ধ্বংসের তুলনায় সেটা অনেক কমে হত!
আইন ভাঙা অপরাধ। এটাও বিরাট দুর্নীতি। আদালতের সঠিক রায় সেটাই প্রমাণ করে। কিন্তু এই আদালতেই যদি মামলার সবপক্ষ, এক বিকল্প চিন্তার প্রকাশ ঘটাতেন, এগিয়ে যেতেন অন্যভাবে। একবার দেশের জন্য, মানুষের টাকা বাঁচানোর জন্য, দুর্নীতির সমূলে বিনাশের জন্য, আইনের সঠিক প্রয়োগের জন্য, মানুষের সংবিধান বাঁচানোর জন্য যদি একবার ভাবতেন। তাহলে, এই ধ্বংসের হত্যালীলা, লাইভ লাইভ খেলার মধ্যে আমরাও একবার দেখতে পেতাম নীড় হারানো পাখিদের আস্তানা পাওয়ার আনন্দের কিচিরমিচির।
সরি, এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। পুরোটাই আমার মনের ভুল। সবকিছু তাই কাল্পনিক!
ক্ষমা করবেন!