
Table of Contents
Bahok News Bureau:
“নয় এই মসজিদ আরবীয় সংস্কৃতির, নয় অধীনে মুঘলীয় কারুকার্যের,
ভিজে মাটি ও সম্প্রীতি দিয়ে তৈরি এই মসজিদ, অস্তিত্ব ৭০০ বছরের’’।।
(The Great Mosque of Djenne)

এই মসজিদ আরবীয় সংস্কৃতির গম্বুজাকৃতি নয়, মুঘল সংস্কৃতির কারুকার্য বিশিষ্ট নয়, এক অন্যই ধরণের মসজিদ। এই মসজিদ টেরাকোটা শিল্পেরও অন্তর্গত নয়। মসজিদটির নিজস্ব পরিচয় আছে। এই বিশালাকার মসজিদ কাদা-মাটি দিয়ে তৈরি। জানেন কোথায় রয়েছে এমন অদ্ভুত মসজিদ?

এই বিশেষ মসজিদটি রয়েছে ‘জেনে’ (Djenne)-তে। যা সাহারা মরুভূমির অদুরে পশ্চিম আফ্রিকার দক্ষিণ মালিতে অবস্থিত। সুদানো-সাহেলিয়ান শিল্প নামক আঞ্চলিক শিল্পের এক সুন্দর উদাহরণ হল ৯১ মিটার দীর্ঘ এবং ২০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট কাদা নির্মিত এই মসজিদটি। যা কাদা ও খড়কুটো মিশ্রিত রোদে পোড়ান ইট এবং কাঠের ভারার সমন্বয়ে গঠিত। ইউনেস্কো সুরক্ষিত জেনের কেন্দ্রবিন্দু হল এই মসজিদ। নাইজার (Niger) ও বানি নদীর (Bani River) প্লাবনভূমিতে অবস্থিত জেনেতে প্রায় ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম বসতি গড়ে ওঠে। এই এলাকা সাহারা-আফ্রিকার অন্যতম প্রাচীন শহর। এই শহর ‘নুন এবং সোনা’ পরিবহনের কেন্দ্রবিন্দু হলে বিশ্বের নজরে আসে।

জেনের চর্চিত মসজিদ: (The Great Grant Mosque of Djenne)
জেনের বিশাল মসজিদটি তিনটি মিনার এবং তালগাছের শতাধিক সোঁটা (যা ওখানে ‘তোরণ’ নামে পরিচিত) গাঁথা দেওয়ালের সমন্বয়ে তৈরি। ১৯০০-এর শুরুর দিকে ফ্রেঞ্চ সাংবাদিক ফেলিক্স ডাবোইস খুব সুন্দরভাবে এই মসজিদকে “হেজহগ এবং চার্চের সংমিশ্রণ” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। প্রচন্ড গ্রীষ্মের সময়েও এই মসজিদ ঠান্ডা থাকে। এই মসজিদের ছাদ ৯০টি কাঠের তৈরি জাফর দিয়ে তৈরি। মসজিদের এই বৈশিষ্ট্য গ্রীষ্মকালে মসজিদটিকে সূর্যের তাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। ছাদগুলির অনেকটা অংশ খোলা থাকে, যা শুষ্ক মরসুমে অবাধে হাওয়া প্রবেশ করতে সাহায্য করে। বর্ষাকালে এলে উন্মুক্ত অংশগুলো টেরাকোটা আবরক দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। মসজিদটির প্রার্থনা কক্ষ একবারে একসঙ্গে প্রায় ৩০০০ লোক ধারণ করতে সক্ষম।

মসজিদ লেপন: (Mosque Plastering)
জেনের অধিবাসীরা বছরে একটি বিশেষ দিনে ঘটা করে একসঙ্গে এই বিশাল মসজিদ লেপার কাজে যুক্ত হয়, যা ‘ক্রেপিসেজ’ (Crepissage) তথা প্লাস্টারিং (Plastering) নামে পরিচিত। যাতে বছরের পর বছর এই মসজিদে টিকে থাকে, মূলত সেই জন্যেই এই কাজ করা হয়। এলাকার মানুষদের উদ্যোগেই প্রায় ৭০০ বছর ধরে ঝড়ঝাপটার মাঝেও কাদা নির্মিত মসজিদটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কাদা নির্মিত প্রায় বাড়িকেই প্রত্যেক বছর মেরামত করার দরকার পড়ে। এই হিসাবে পুরনো মাটির বাড়িকেও টিকিয়ে রাখার জন্য প্রত্যেক বছর লেপার দরকার পড়ে। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। জেনের বিশালাকার মসজিদে জুলাই-আগস্ট মাসে বর্ষাকালের ঠিক আগে লেপার কাজ শুরু হয়। বর্ষায় এই শহরে গড়ে প্রায় বার্ষিক ১০০০ মিলি বৃষ্টি পড়ে। আর তাই বর্ষাকালের আগে সম্মিলিতভাবে মসজিদ লেপার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যাতে তা বর্ষার সময় টিকে যায়।

‘ক্রেপিসেজ’ (Crepissage) শুধুমাত্র যে মসজিদকে ফাটল ধরে যাওয়া বা ক্ষয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য করা হয় তা নয়। জেনের অধিবাসীদের কাছে এই কাজ উৎসব পালনের মতো। উল্লেখ্য, এই উৎসব ‘ক্রেপিসেজ দি লা গ্র্যান্ড মস্ক’ (Crepissage De La Grand Mosque) নামেও পরিচিত। উৎসবের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের দীর্ঘদিনের বিশ্বাস এবং ঐতিহ্য উদযাপন করে। লেপার কাজ শুরু করার ঠিক আগের রাতে গ্রামবাসীরা একসঙ্গে নাচ-গান করে। এই অনুষ্ঠান ‘লা-নিউট-দে-ভিলি'( দ্য ওয়াকিং নাইট) নামে পরিচিত। জ্যোৎস্না রাতে জেনের সমগ্র রাস্তাঘাট স্তবধ্বনি এবং ড্রামের আওয়াজে ভরে যায়। ঠিক ভোর চারটের সময় হুইসালের আওয়াজে সবকিছু শান্ত হয় এবং শুরু হয় ক্যালেন্ডারের বহু প্রতীক্ষিত সম্মিলিত উৎসব।

কীভাবে লেপা হয় মসজিদ?
প্রথমে সবাই এক একটি দল তৈরি করে। পরে এই দল যত্নসহকারে মসজিদ (Mud Mosque of Mali) লেপার কাজ শুরু করে। একটি সমবায় সঙ্ঘের তদারকিতে ৮০ জন বরিষ্ঠ রাজমিস্ত্রির (জেনের অত্যন্ত সম্মানীয় পেশা) অধীনে এই কাজটি সম্পন্ন হয়। যুবক ছেলেরা এই মসজিদের বাইরের দিকে মইয়ের সাহায্যে বা তোরণের সাহায্যে হামাগুড়ি দিয়ে ওঠে এবং কঞ্চিনির্মিত ঝুড়িতে কাদা নিয়ে দেওয়ালে মোটা স্তরের প্রলেপ দেয়। প্রত্যেকটা দল তাঁর ভাগে পড়া কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে জয়-পরাজয়েরও একটা ব্যাপার থাকে। কারণ, বিজয়ী দল ৫০,০০০ পশ্চিমী আফ্রিকার সিএফএ ফ্রাঙ্কস (প্রায় £৬৮.৫০) মূল্যের আর্থিক পুরস্কার পায়। যে শহরে বেশিরভাগ মানুষই দিনে £১-এর কম আয় করে, সেই শহরে এই মূল্যের আর্থিক পুরস্কার বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

প্রত্যেক দলই নিজের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালায় এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার চেষ্টা করে। ছেলেদেরকে লেপার জন্য বিশেষ মিশ্রণের কাদা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। আশেপাশের নদী থেকে প্রাপ্ত বিশুদ্ধ মাটি, চালের তুষ, শিয়া বাটার, বাওবাব গাছের ফলের গুঁড়ো এবং জল ভালো করে মিশিয়ে মসজিদ লেপার বিশেষ মিশ্রণটি তৈরি করা হয়। এই মিশ্রণ ‘ব্যাঙ্কো’ নামে পরিচিত। ছেলেরা এইদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করে প্রচুর পরিশ্রম করে চুপড়ি ভরে বিপুল পরিমাণে ‘ব্যাঙ্কো’ মসজিদে নিয়ে যায়।

‘ক্রেপিসেজ’-এর তাৎপর্য: (Significance of Crepissage)
‘ক্রেপিসেজ’-এর দিনটিজেনের বাসিন্দাদের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই বিশেষ দিনে মেয়েরা মসজিদে যাওয়ার অনুমতি পান এবং ‘ব্যাঙ্কো’ তৈরির জন্য নদী থেকে জল আনার কাজে নিজেদের নিযুক্ত করার সুযোগ পান। বাচ্চারাও রাজমিস্ত্রিদের সাহায্য করার জন্য ‘ব্যাঙ্কো’ বওয়ার কাজে অংশগ্রহণ করে। তবে বেশিরভাগ বাচ্চারাই হৈ হুল্লোড় করে কাদায় খেলতে ব্যস্ত থাকে। প্রায় ৫ ঘণ্টা যাবৎ কাজ করার পরে সকাল ৯টা নাগাদ মসজিদে ‘ব্যাঙ্কো’ লেপনের কাজ শেষ হয়।

ইউনেস্কোর মতে, জেনে সম্প্রীতি, স্থাপত্যশিল্প এবং আঞ্চলিক কারিগরির মিশ্রণের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ’। ইউনেস্কোর এই মতামতকে কার্যত সত্য প্রমাণিত করে ‘ক্রেপিসেজ দি লা গ্র্যান্ড মস্ক” উৎসব। ১০০ বছরেরও বেশি বয়সের এই মসজিদ আধুনিক সমাজের অংশ হয়ে থেকে গেছে। জেনের মেয়র বালাসিন য়ারো বলেছেন, “জেনের এই মসজিদ প্রত্যেক বছর ‘সামাজিক সংহতির’ সাক্ষী দেওয়ার পাশাপাশি মসজিদের যত্ন নেওয়ার কাজে সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণকারী জনসাধারণের সামাজিক চেতনাবোধের এবং একসাথে মিলেমিশে থাকার সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটায়”।
Who founded Digha? : ‘দীঘা’র প্রতিষ্ঠাতা কে?, দীঘার কথা ইতিহাসের পাতায়- প্রথম পর্ব
পড়ুন: বাহক ঈদ সংখ্যা ২০২৩
পড়ুন: বাহক শারদীয়া সংখ্যা / পুজো ম্যাগাজিন ১৪২৯
PDF টি ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন – বাহক ঈদ সংখ্যা ২০২৩
ঈদ সংখ্যা কেমন লাগলো, ফেসবুক পেজ ছাড়াও নিচের কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। আপনার নাম দিয়ে মতামত দিতে পারেন।
এছাড়াও আমাদের পূর্বে প্রকাশিত কিছু সংখ্যা সমূহের Pdf নিচে দেওয়া হল।