
Bahok News Bureau: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর (Subhas Chandra Bose) নাম বাঙালির স্মরণে চিন্তনে মননে রয়েছে। ২৩শে জানুয়ারি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিন। ছোটবেলায় স্কুলের পাঠ্যবয়ে বা প্রতিযোগিতা মূলক চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে নেতাজী সম্পর্কে আমরা বেশ কিছু তথ্য জানার সুযোগ পাই। কিন্তু, স্কুলের বা চাকরির পরীক্ষার চাপের মধ্যেও খুব কম মানুষ থাকেন, যারা সত্যিই সেই তথ্যগুলো জানার চেষ্টা করেন। নচেৎ বেশিরভাগ মানুষকেই সেই ইঁদুর দৌড়ের মাঝে ব্যস্ত হয়ে সাধারণত পড়া মুখস্ত করতে দেখা যায়। আপনি যদি নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজ সংক্রান্ত কিছু অজানা তথ্য জানার অপেক্ষায় আছেন,তাহলে এসেছেন একদম সঠিক ঠিকানায়। এই বিশেষ প্রতিবেদনে বিভিন্ন পরীক্ষার ঊর্ধ্বে পেশ করা হল নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজ সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অজানা তথ্য।
বিংশ শতাব্দীর ৪০-এর দশক পরাধীন ভারতের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘আজাদ হিন্দ ফৌজের’ (Azad Hind Fauj) গঠন। পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার তখন জাতীয়তাবাদের প্রতিধ্বনিতে কম্পিত। সেই সময়ে ভারতকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে ভারতের বাইরে যে সমস্ত শক্তি গড়ে তোলা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’।
রাসবিহারী বসুর (Rash Behari Bose) উদ্যোগে জাপান সরকারের সহায়তায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ১৯৪২ সালে গঠিত হয় ‘আজাদ হিন্দ বাহিনী’। ওই বছর তিনি টোকিওতে ২৮-২৯ মার্চ তারিখে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেই সম্মেলনেই গৃহীত হয় ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ’ (Indian Independence League) তৈরির সিদ্ধান্ত। এরপরে এই লিগে যোগদানকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আরেক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। যা আয়োজিত হয় ওই বছরেই ২২ জুন তারিখে ব্যাংককে।
এই সম্মেলনে একইসঙ্গে ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ’-এর সশস্ত্র শাখায় যোগদানের জন্য মালয় ও ব্রহ্মদেশের সেনাদের উৎসাহ দেওয়া হয়। এঁরা মুলত ভারতীয় সেনা ছিল, যারা জাপানের তরফে চালানো মালয় ও সিঙ্গাপুর অভিযানের সময় বন্দী হয়েছিল। তবে, আইএনএ-এর অংশ শুধুমাত্র ভারতীয় বন্দীরাই ছিল না। মালয় ও ব্রহ্মদেশের বহু প্রবাসীও স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। এরপরে ১৯৪২ সালে রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি তথা ‘প্রথম আইএনএ’ গঠিত হলে, সেটার ক্ষমতা পরবর্তীকালে স্থানান্তরিত হয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে।
উল্লেখ্য, নেতাজি আইএনএ-এর দায়িত্ব নিলে তিনি বাহিনীর পুনর্গঠন করেন। সেই সময়ে ওই বাহিনীতে ১৪ হাজার আধিকারিক ও ৫০ হাজার সৈনিক ছিল। বাহিনীতে দায়িত্বও পদ অনুযায়ী ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল জেনারেল, মেজর, কর্নেল, ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, মেজর জেনারেল, লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের মতো পদ। এছাড়াও, তৈরি করা হয়েছিল সাব-অফিসার, নায়েক, হাবিলদার, লান্স নায়েকের মতো পদও।
এই বাহিনী ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর তারিখে নেতাজি কর্তৃক পুনর্গঠিত হলে তা স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার তথা ‘আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ’ তথা ‘আজাদ হিন্দ সরকার’-এর সেনাবাহিনী ‘দ্বিতীয় আইএনএ’-রূপে পরিচিতি লাভ করে। এরপরে এই বাহিনী ব্রহ্মদেশ, কোহিমা ও ইম্ফলে ব্রিটিশ সরকারের ও কমনওয়েলথ বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। যদিও পরবর্তীকালে চালানো ব্রহ্মদেশ অভিযানে তাঁরা ব্যর্থ হয়। এই অবস্থায় এই ফৌজের বহু সেনাকে ভারতে ফেরত আনা হয়। এই সেনার কিছু অংশ যেখানে স্বাধীন ভারতের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়, সেখানে বেশিরভাগ জনকেই যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে দেখা যায়।
প্রসঙ্গত, যে জাপ সরকারের অনুমোদন ও সহযোগিতায় আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হয়েছিল, সেই জাপ সরকারেরই সেনাবাহিনীর জেনারেল ফুজিহারা আজাদ হিন্দ বাহিনীর নিয়ে এক বিশেষ মন্তব্য করেন। নিজ মন্তব্যে যেখানে তিনি বাহিনীর মনোভাবের ও মনোবলের প্রশংসা করেন, সেখানেই তিনি আবার বাহিনীর রণকৌশলেও প্রশ্ন তুললেন। তাঁর কথায়, “বৈপ্লবিক আঙ্গিকে বাহিনীর মধ্যে ভালো মনোভাবের অভাব ছিল না, ছিল বেশ সুসংগঠিতও। তবে, এই বাহিনীর মধ্যে সঠিক রণকৌশল ও আক্রমণ ক্ষমতায় অভাব ছিল”।
এই অবস্থায় নেতাজি বাহিনীর পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এই মর্মে তিনি অনুসরণ করেন জার্মানির এস-এস দল অথবা রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির পথ। এই সিদ্ধান্তের অধীনে তিনি পুরো আজাদ হিন্দ ফৌজকে জাপানি সামরিক আইন থেকে মুক্ত করেন এবং নিজস্ব সামরিক বিধির আওতায় আনেন। এমনটা করার পরে দেশজুড়ে থাকা বিভিন্ন ভাষাবর্ণধর্ম নির্বিশেষে বহু মানুষ এই বাহিনীতে যোগদান করলে বাহিনীকে মোট ২০টি রেজিমেন্টে ভাগ করে দেন।
আরও পড়ুন: Jatindra Nath Das Death Reason: যতীন্দ্রনাথ দাস স্মরণীয় কেন?, মৃত্যুর কারণ ও জীবনী
অবশেষে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন হলে নতুন করে শপথ নেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যরা। শাহানওয়াজ খানের (Shah Nawaz Khan) ‘মাই মেমারিজ অব দ্য আইএনএ অ্যান্ড ইটস নেতাজি’ (My Memories of I.N.A. and Its Netaji)-এর দৌলতে সেই শপথবাক্য পাঠ সম্পর্কেও কিছু তথ্য জানা যায়। সেই শপথবাক্য পাঠেরই কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হল, “আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে আমরণ লড়াই করে যাবো। হারতে হলেও জাতীয় ত্রিবর্ণ পতাকা উঁচু করে লড়াই করতে করতে হারবো, পরাজিত হবো। এই আত্মত্যাগের দৌলতে ভবিষ্যতে ভারতীয়রা স্বাধীন মানুষ হিসেবে জন্ম নেবে, ক্রীতদাস হিসাবে নয়।… ভারতের স্বাধীনতা অবধারিত, সেই দিন বেশি দূরে নাই”।